ভেজাল খাবারে স্বাস্থ্য ঝুঁকি

ভেজাল খাবারে স্বাস্থ্য ঝুঁকি

 জ্যৈষ্ঠ  আষাঢ় মধু মাসে বাংলাদেশে বিভিন্ন মুখ রোচক ফলের সরবরাহ ঘটে। শিশু কিশোর থেকে সকল বয়সের মানুষই ফল খেতে ভালবাসে। এইসব ফল আমাদের দেহের জন্য খাদ্য ও পুষ্টি যেমন, শর্করা, ভিটামিন, পটাশিয়াম, আয়রণ, জিংক ইত্যাদি দান করে। তাই সুখে দুখে, অসুখে বিসুখে, ফলের চাহিদা সারা বছর ধরেই রয়েছে, বিশেষ করে অসুস্থ হলে মুখের রুচি যখন থাকেনা। রোগী ক্লান্ত পরিশ্রান্ত থাকে। লিভারের অসুখেরতো কথাই নাই। সবাই ফল খেতে, ফল দিতে পছন্দ করে। সারা বছর ধরে ফলের চাহিদা থাকলেও মধ্যম শ্রেণী কিংবা গরীবের পক্ষে অধিক মূল্যে আমদানীকৃত ফল সব সময় খাওয়া সম্ভব হয় না। তাই বাংলাদেশে মধু মাসগুলোতে সবাই আগ্রহভরে কোন না কোন ফল পরিবার পরিজন নিয়ে খেতে সচেষ্ট হন।

শাকসবজি, মাছ ও মাংসে ভেজালতো নিত্যদিন রয়েছেই। ফরমালিন মুক্ত মাছ পাওয়া দুষ্কর। তাছাড়া কৃত্রিমভাবে প্রজননের মাধ্যমে বাজারজাত মাছ, মাংস আমরা সব সময় খাই। মাছকে ইউরিয়া সার খাওয়ানো হয় এবং গরুর বর্জ্য চামড়া আগুনে পুড়িয়ে এক প্রকার খাদ্য বানিয়ে মাছকে খাওয়ানো হয়, এমনকি ফার্মের বয়লার মুরগীর বর্জ্য খাওয়ানো হয়। গরুকে বলিষ্ঠ করার জন্য আখের গুড়ের তৈরীর বর্জ্য (রাব) যা এলকোহল সমৃদ্ধ এবং এমনকি ইউরিয়া মিশ্রিত ঘাস ও খড় খাওয়ানো হয়। এসমস্ত রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত খাবার যে গরু খায় সে গরুর মাংস আমরা খাই এ খাবার কতটুকু স্বাস্থ্য সম্মত তাও নিরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। পোলট্রি ফার্মের মুরগীকে মোটাতাজা করার জন্য নানাবিধ কেমিক্যাল মিশ্রিত খাবার খাওয়ানো হয়। শুকনো ও পঁচা গন্ধযুক্ত ডিডিটি মিশ্রিত শুটকি দিয়েও মুরগীর খাবার তৈরী করা হয়। তাছাড়া শুটকি মাছকে টাটকা ও পোকা মাকড় থেকে রক্ষা করার জন্য ডিডিটি মিশানো হয়।  কালে অকালে সব রকমের সবজি আমাদের দেশে পাওয়া যায়। এটা সম্ভব হচ্ছে অতিরিক্ত সার ও কীটনাশক প্রয়োগের মাধ্যমে। এ সমস্ত শাকসবজির গুণগতমান এবং সেফটি দেখার সময় এসেছে।

প্রাকৃতিক উপায়ে চাষকৃত কোন খাবারই এখন আমাদের ভাগ্যে জোটেনা। হয়তো বা জনসংখ্যার চাপ, প্রয়োজনের তুলনায় কম সরবরাহ হবে বলে সবাই বিকল্প পথ অবলম্বন করে অধিক উত্পাদনের সাহায্যে সাময়িক চাহিদা পুরণের মনযোগী হয়েছে। এই ভেজাল ও বিষ গ্রহণের ফলে মানবদেহে কি প্রতিক্রিয়া হচ্ছে তা দেখার প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের দেহ দিন দিন নানাবিধ দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। যেমন অকালে ক্যান্সার, লিভার রোগ, কিডনিরোগ এবং রক্ত শূন্যতা ইত্যাদি নানা রোগ ব্যাধির প্রকোপ বেড়েই চলেছে। সাধারণত কাঁচা কলাকে ইথাইলিন গ্যাস দ্বারা পাকানো হয়। ইহা একটি গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়া কেননা মৌসুমী ফল এই প্রক্রিয়াতে পাকে।

কিন্তু সমস্যাটা হলো অধিক মুনাফা লোভি কিছু সংখ্যক ব্যবসায়ী কাঁচা মৌসুমী ফল যেমন  আম, কলা, পেঁপেঁ, নাশপাতি, কুল ও আপেলকে ক্যালসিয়াম কার্বাইড নামক বিষাক্ত কেমিক্যাল দিয়ে পাকায়। এই ক্যালসিয়াম কার্বাইড একটি সহজ লভ্য ও তুলনামূলকভাবে সস্তা কেমিক্যাল। ঈত্ুংঃধষষরহব কমপাউন্ড যা শিল্প কল কারখানায় সাধারণত: ব্যবহার হয়ে থাকে। দেখতে গাঢ় দূষর রং। অনেকটা রসুনের মত গন্ধ ছড়ায়। ইহা সাধারণত ষ্টীল জাতীয় পদার্থের ওয়েল্ডিং কাজে ব্যবহূত হয়। ব্যবসায়ীরা আম কিংবা অন্যান্য ফলকে সারিবদ্ধভাবে বসিয়ে ক্যালসিয়াম কার্বাইড ছোট ছোট খোলা পাত্রে  মিশিয়ে সারি সারি করে বসিয়ে তার পর পলিথিন বিছিয়ে দেয়। এ বিষাক্ত কেমিক্যাল বাতাসে জলিয় বাষ্পের  সংস্পর্শে আসলে এসিটাইলিন গ্যাস তৈরী হয়। এই গ্যাস ফল পাকাতে সাহায্য করে। ক্যালসিয়াম কার্বাইডে আর্সেনিক ও ফসফরাস জাতীয় রাসায়নিক পদার্থ থাকে। এসিটাইলিন গ্যাস স্নায়ুতন্ত্র তথা ব্রেইনের অক্সিজেন সরবরাহ কমিয়ে দেয়। আর্সেনিক, চর্ম, লিভার, কিডনি, ফুসফুস সহ মানব দেহে মারাত্মক ক্ষতি করে।

ক্যালসিয়াম কার্বাইড সল্প মেয়াদী ও দীর্ঘ মেয়াদী স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে। সল্প মেয়াদী রোগের উপসর্গ সমূহ ১. চোখ ও চামড়ার সংস্পর্শে আসলে জ্বালা পোড়া এবং চোখের অন্ধত্ব এবং চামড়ায় ঘা হতে পারে ২. শ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করলে গলা ব্যথা, কাশি ও শ্বাস কষ্ট হতে পারে। ৩. খাবারের মাধ্যমে গ্রহণ করলে মুখে ঘা হতে পারে। ৪. অতি মাত্রায় গ্রহণ করলে শ্বাস কষ্ট এমনকি ফুসফুসে পানি জমে যেতে পারে। দীর্ঘ মেয়াদী স্বাস্থ্য ঝুকির মধ্যে রয়েছে ফুসফুসের উপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব যেমন- কফ্, কাঁশি ও এজমা। কেমিক্যাল দিয়ে পাকানো ফল চেনার উপায় কি?

১।         উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, আম কাঁটার পর চামড়ার ঠিক নীচে ফলের অংশ কাঁচা পাওয়া যাবে। যদিও চামড়াটি পাকা রং এ বর্ণ ধারণ করেছিল।

২।         যদি ঝুড়িতে বা দোকানে সব গুলো ফল একই সময়ে একই রকম পাকা দেখা যায় এবং দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে ফলের চামড়ায় আচিল বা তিলের মত রং দেখা যায়।

৩।        প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় যে ফল পাকে তাতে মাছি বসবে কিন্তু ক্যামিক্যাল দ্বারা পাকানো হলে সে ফলে মাছি বসবে না।

৪।         প্রাকৃতিক ভাবে পাকা ফলের চামড়া উঠানোর পর এক ফোটা আয়োডিন দিলে তা গাঢ় নীল অথবা কালো বর্ণ ধারণ করে। কিন্তু ক্যামিক্যাল দ্বারা পাকানো ফলে এই আয়োডিনের রং অপরিবর্তিত থাকে।

আপনার করনীয়:

১।         ফল খাওয়ার পূর্বে কয়েক মিনিট পানি দিয়ে ভাল করে ধুয়ে নিন।

২।         মৌসুমের পূর্বে বাজারের যে পাকা ফলগুলো আসে সেগুলো ধরেই নিতে পারেন যে, কেমিক্যাল দ্বারা পাকানো হয়েছে।

৩।        যখন আম এবং আপেল জাতীয় ফল খাবেন তখন এগুলো টুকরো টুকরো করে খাবেন। পুরো ফল কামড়ে না খাওয়াই ভাল।

আমাদের সবার দায়িত্ব জনগনকে সচেতন করে তোলা। ফল উত্পাদনকারী কৃষক, ব্যবসায়ী ও খুচরা বিক্রেতাদেরকে ফল পাকানোর নিরাপদ প্রক্রিয়া শিক্ষা দেওয়া। যেমন আমের ক্ষেত্রে সারি সারি করে আম খড়ের গাদায় বসিয়ে রাখলে আম পেকে যাবে। তা ছাড়া গাছ থেকে ফলগুলো পরিপক্ষ হওয়ার পর আম পারা ভাল। ফলের পেশায় যারা নিযুক্ত রয়েছে তাদেরকে ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহারের ক্ষতির দিকগুলো শিক্ষা দিতে হবে। যারা মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্য নিয়ে খেলা করে এবং মানুষের জীবনকে ঝুকির মধ্যে ফেলে দেয় তাদেরকে আইনের মাধ্যমে শাস্তি ও অর্থ দন্ডের বিধান করা একান্ত প্রয়োজন। যা অন্যান্য দেশে প্রচলিত রয়েছে। 

উপরে উল্লেখিত সব রকম ভেজাল ও ক্যামিক্যাল মিশ্রিত খাবার খেয়ে আমরা বেঁচে আছি। তাই  আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের স্বাস্থ্যহানী, মেধা ও মননশীলতা কতখানি বিঘ্নিত হবে এবং হচ্ছে এ দিকে নজর দেওয়ার সময় এসেছে।

Leave a comment