মানুষ গড়তে ইসলামী শিক্ষা

পড়ুন হে রাসূল সাঃ আপনার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন­ (সূরা আলাক ১-২)। ‘বিদ্যাচর্চা করা বা শিক্ষা অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য ফরজ (অবশ্য কর্তব্য)। ­হাদিস

কবি ও দার্শনিক আল্লামা ইকবাল বলেছেন, ‘মানুষের খুশির বা রূহের উন্নয়নই আসল শিক্ষা।’

জন মিল্টন বলেছেন­ এডুকেশন ইজ দা হারমোনিয়াস ডেভেলপমেন্ট অব মাইন্ড, বডি অ্যান্ড সোল।

বিশিষ্ট দার্শনিক সক্রেটিস শিক্ষার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন­ ‘নিজেকে জানার নামই শিক্ষা’। হারম্যান হর্ন লিখেছেন, ‘শিক্ষা হচ্ছে শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে মুক্ত সচেতন মানবসত্তাকে সৃষ্টিকর্তার সাথে উন্নত যোগসূত্র রচনা করার একটি চিরন্তন প্রক্রিয়া, যেমনটি প্রমাণিত রয়েছে মানুষের বৃদ্ধিবৃত্তিক, আবেগগত ইচ্ছাশক্তি সম্বন্ধীয় পরিবেশ’।

আমেরিকান শিক্ষাবিদ জন ডেউয়ে শিক্ষার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন­ ‘প্রকৃতি এবং মানুষের প্রতি বুদ্ধিবৃত্তি, আবেগ ও মৌলিক মেজাজ প্রবণতা বিন্যাস করার প্রক্রিয়াই শিক্ষা।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দি রিলিজিয়ন অব ম্যান গ্রন্থে বলেছেন­ ‘মানুষের অভ্যন্তরীণ সত্তার পরিচর্যা করে খাঁটি মানুষ বানানোর প্রচেষ্টাই হচ্ছে শিক্ষা।’

অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে বলা হয়েছে­ এডুকেশন ইজ এ প্রোসেস অব টিচিং, ট্রেইনিং অ্যান্ড লারনিং টু ইমপ্রুভ নলেজ অ্যান্ড ডেভেলপ স্কিলস।

শিক্ষার ইতিহাস খুঁজতে হলে আমাদের পৃথিবীর প্রথম মানুষটির কাছে যেতে হবে। আদম আঃ হচ্ছেন­ মানবজাতির প্রথম ও আদি শিক্ষাগুরু। আর তিনি যে উৎস থেকে জ্ঞান লাভ করেন তা হচ্ছে ওহি। তারপর দীর্ঘ পথপরিক্রমা। হাজার হাজার বছর আইয়্যামে জাহিলিয়াতের অমানিশার ঘোর অন্ধকার ভেদ করে জন্ম নিলেন জগতের শ্রেষ্ঠতম মানুষ বিশ্বের আলোকবর্তিকা, সমগ্র পৃথিবীর রহমত, রাহমাতুল্লিল আলামিন, মানবজাতির মহান শিক্ষক শ্রেষ্ঠ দার্শনিক হজরত মুহাম্মদ সাঃ।

মানবজাতির সর্বাধিক ও সর্ববিভাগের শ্রেষ্ঠ মডেল হজরত মুহাম্মদ সাঃ। তাঁর ওপর যে ওহি আসত, আমাদের যা শিক্ষণীয় আর তা হলো­ মুসলিম মিল্লাতকে শত ভাগ শিক্ষিত হতে হবে। আল্লাহর কালাম এবং হাদিসে রাসূল সাঃ থেকে শিক্ষার যে গুরুত্ব, তাকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। অথচ মুসলিম শাসকরা এ বিষয়ে যথার্থ গুরুত্ব দিচ্ছেন কি?

বর্তমান বিশ্বে কর্তৃত্বের যে লড়াই চলছে তার মূল হচ্ছে ইলম বা জ্ঞান। আমরা তাকে যেভাবেই দেখি না কেন, এ লড়াই হচ্ছে মূলত জ্ঞানের লড়াই। আমাদের সব দিকে জ্ঞানী হতে হবে। আর এ শিক্ষা আমরা প্রত্যেক নবী বা রাসূল সাঃ-এর কাছ থেকে পাই। ইতিহাসের আলোকে আমরা দেখতে পাই, প্রত্যেক নবী-রাসূলকে সমসাময়িক কালে সব বিদ্যায় শ্রেষ্ঠ করে পাঠানো হয়েছে। আর আমরা মুসলিম মিল্লাত সমকালীন বিদ্যা অর্জনের ক্ষেত্রে কত যে পিছিয়ে আছি তা আমাদের বর্তমান অবস্থাই বলে দেয়। এ দিকে লক্ষ রেখে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন­ ‘ভিখারীর বেশে খলিফা যাদের/শাসন করিল আধা জাহান,/তারা আজ পড়ে ঘুমায় বেহুঁশ/বাহিরে বইছে ঝড়-তুফান।’

শিক্ষার উদ্দেশ্যঃ আমাদের শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য কী? এ সম্পর্কে অনেক শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ মন্তব্য পেশ করেছেন। তাদের মধ্যে আল্লামা ইকবাল বলেছেন­ ‘পূর্ণাঙ্গ মুসলিম তৈরী করাই হচ্ছে শিক্ষার উদ্দেশ্য।’ প্রফেসর মুহাম্মদ কুতুব কনসেপ্ট অব ইসলামিক এডুকেশন প্রবন্ধে বিস্তারিত লিখেছেন, যার সারমর্ম আমরা এভাবে উল্লেখ করতে পারি­ ‘শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানসিক উৎকর্ষ সাধন।’ প্লেটোর মতে, ‘শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো মিথ্যার বিনাশ আর সত্যের আবিষ্কার।’ অ্যারিস্টটল বলেছেন­ ‘শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো ধর্মীয় অনুশাসনের অনুমোদিত পবিত্র কার্যক্রমের মাধ্যমে সুখ লাভ করা।” মহাকবি মিল্টন শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছেন­ অর্থাৎ শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে দেহ, মন ও আত্মার সমন্বিত উন্নতিসাধন। তিনি আরো বলেছেন­ ‘শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যক্তিচেতনা এবং সঠিক ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলার মাধ্যমে জাতীয় চেতনা এবং সঠিক নেতৃত্ব সৃষ্টি করা। বিখ্যাত শিক্ষাবিদ হার্বার্ট বলেছেন, ‘শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে শিশুর সম্ভাবনা ও অনুরাগের পূর্ণ বিকাশ ও তার নৈতিক চরিত্রের কাঙ্ক্ষিত প্রকাশ।’ এভাবে শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে যত মতামত এসেছে সব কথার মূল হচ্ছে নৈতিক আচরণ, আত্মপরিচয় ও দায়িত্বানুভূতি বিকাশে সাহায্য করাই শিক্ষার উদ্দেশ্য।

১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার করুণ পরাজয়ের মাধ্যমে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিতই হয়নি শুধু, অবসান ঘটে ৭০০ বছরের ঐতিহ্য মুসলিম শাসনের। তারা ধ্বংস করে দেয় ইসলামী শিক্ষা, সাহিত্য, সভ্যতা ও সংস্কৃতি। সে দিন সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে আমাদের গলায় গোলামির শিকল পরানো হয়। প্রায় ২০০ বছর শোষণ করে তারা তাদের প্রয়োজনের আলোকে যে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছিল, আমরা আজো সেটি অনুসরণ করে চলেছি। তাই আজ আমাদের শিক্ষানীতি ইসলাম ও আধুনিকতার সমন্বয়ে প্রণয়ন হওয়া দরকার।

আমাদের দেশে প্রচলিত সাধারণ শিক্ষার প্রথম শ্রেণী থেকে শেষ পর্যন্ত যা কিছু পড়ানো হয়, তার প্রায় সবটুকু ইসলামবিমুখ অনূর্ধ্ব মস্তিষ্কের ফসল। তাতে ইসলামের জীবনদর্শন প্রতিফলিত হয় না। অকাট্য সত্য কথা হচ্ছে, এর মাধ্যমে প্রতিটি ছাত্রের মন-মগজ অনৈসলামিক ভাবধারায় পুষ্ট হয়। যেমন­ শুরুতে পড়ানো হয় অ-তে অজগর, আ-তে আম ইত্যাদি। তাহলে শুরুটা যদি হয় হিংস্র প্রাণী দিয়ে তার কোমলমতি মনটা নিশ্চয় হিংস্র মনোভাব নিয়ে উঠবে। শেখানো হয়­ ‘লেখাপড়া করে যে, গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে।’ এ কথার মাধ্যমে তাকে ধারণা দেয়া হয় যে, পড়ালেখা করো, তাহলে বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়িতে চড়তে পারবে। দুধ-পানি মেশানোর অঙ্ক, সুদ কষার মাধ্যমে তাকে ধোঁকাবাজ, প্রতারক, সুদখোর বানানো হয়। বাঘ ও বকের গল্প পড়ে ক্ষমতার অপব্যবহার, টোনাটুনির গল্প পড়ে ধোঁকাবাজি, ছেলে-বুড়োর কবিতা পড়ে বেয়াদবির শিক্ষা পেয়ে থাকে। তুমি যদি তোমার সন্তানকে তিনটি ‘আর’ মানে পড়া, লেখা এবং অঙ্ক বা হিসাব শিক্ষা দান করো আর চতুর্থ ‘আর’ অর্থাৎ ধর্মকে বাদ রাখ তাহলে পঞ্চম ‘আর’ বর্বরতাই পাবে। আল্লামা ইকবাল বলেছেন­ ‘শিক্ষা বা রাজনীতি থেকে যদি ধর্মকে বাদ দাও বা আলাদা করে ফেল তাহলে তো শুধু চেঙ্গিসই বাকি থাকে।

এমন পড়া মুসলিম মিল্লাত পড়বে না বা এমন শিক্ষায় শিক্ষিত হবে না, যে শিক্ষায় শিক্ষিত হলে তারা পরবর্তী বাস্তব জীবনে আল্লাহ ও রাসূল সাঃ-এর কথা ভুলে যাবে বা সেই আদর্শের বিপরীত জীবন চালাবে। অথচ আমরা কি দেখছি আমাদের সমাজে যারা সমাজপতি, দার্শনিক, বুদ্ধিজীবী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, শিক্ষক, অধ্যাপক, ব্যবসায়ী, ডাক্তার তথা শিক্ষিত জনসমাজ যত উঁচু ডিগ্রিই নিচ্ছেন না কেন, তারা তাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নৈতিক জীবন আল কুরআনের শিক্ষার আলোকে চালাতে রাজি নয়। বরং এ থেকে দূরে চলাকেই অনেকে প্রগতির দাবি বলে মনে করছেন। আজকের মুসলিম মিল্লাতের যে অধঃগতি যে পশ্চাৎপদতা তা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে আমাদের ওহির জ্ঞান তথা আল কুরআনের দিকে ফিরে আসতে হবে। আল্লাহ বলেন­ ‘যে আল্লাহর জিকির অর্থাৎ আল্লাহর কুরআন ও রাসূল সাঃ-এর আদর্শ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জীবিকা সঙ্কীর্ণ হবে আর কেয়ামতের দিন আমি অন্ধ বানিয়ে তাকে পুনরুত্থিত করব।’ (আল কুরআন)

আমরা যদি একটি সুস্থ, সু্‌ন্দর ও সমৃদ্ধশালী জাতি হিসেবে নিজেদের গড়তে চাই তাহলে আমাদের ন্যায়, সততা, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা, সত্যবাদিতার অধিকারী হতে হবে। তাই আসুন আমরা সবাই মিলে শিক্ষার মূল যে উদ্দেশ্য তার দিকে ফিরে যাই­ ফিরে যাই হেরার রশ্মির কাছে। তাহলেই এ সমাজ সুন্দর, সমৃদ্ধ ও সাবলীল হবে­ যে সমাজে সবাই যার যার অধিকার ভোগ করতে সক্ষম হবে।

Leave a comment