অনুভব

অনুভব
দূরে কোথায় যেন একটা শব্দের মতো হচ্ছে। অস্পষ্ট শব্দটা মস্তিষ্কের কোষে গিয়ে আঘাত করছে।
ঠিক বোঝা যাচ্ছে না কি হচ্ছে। কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার মাত্র। তারপর নন্দিনী বুঝতে পারল ফোন
বাজছে। এটা ফোনের শব্দ। একলা ঘরে ঘুমিয়ে ছিল নন্দিনী। ধড়মড় করে উঠে ফোন ধরল। অন্ধকার
ঘর। ফোনটা মাথার কাছেই। ঘুমোনোর সময় সাউন্ড কমিয়ে রেখেছিল। অসময়ে ফোন বাজলে কেন যেন
বুকটা ধক করে ওঠে। ফোন কি আর সব সময় সুখের বার্তাই বহন করে? তাছাড়া কোনো শব্দে কাঁচা ঘুম
ভেঙে গেলে আর ঘুম আসবে না। রাতভর নির্ঘুমই কাটাতে হবে। নন্দিনীর সহজে ঘুম আসে না
আজকাল। অনেক কসরত করে ‘ঘুম’ নামক শব্দটির দেখা পাওয়া যায়। প্রতিদিন ভাবে, ফোনটা অন্য
ঘরে সরিয়ে রাখবে কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠে না। অনুভব যদি ফোন করে। অনুভব সাধারণত অসময়ে
ফোন করে না। তবুও কোনোভাবেই ওর ফোন মিস করতে চায় না।
ফোন ধরেই বুঝল, ওভারসিজ কল এবং নিশ্চিত শাহরিয়ারের ফোন। ওর কি সময়জ্ঞান কখনো হবে
না? শাহরিয়ার থাকে ক্যালিফোর্নিয়া। ওখানকার একটা ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়। ছাত্র পড়ানো আর
বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকাই ওর কাজ। শাহরিয়ার একটা জড়বস্তু যেন। না আছে কোনো রোমান্স, না
কোনো আকাক্সক্ষা। কেন যে এসব লোক সংসারী হতে যায়? বছরে এক-দুবার বাংলাদেশে আসে ঠিকই,
তাও ব্যস্ত থাকে এই ইউনিভার্সিটি ওই ইউনিভার্সিটিতে লেকচার দিয়ে। ঘরে ফিরে নাক ডেকে ঘুমায়।
নন্দিনী বিয়ের পর কয়েক বছর শাহরিয়ারের সঙ্গেই ছিল। তখন ওরা ছিল টরন্টোতে। ইয়র্ক
ইউনিভার্সিটিতে পড়াত শাহরিয়ার। চার বছর পরে চলে যায় আবার আমেরিকা। ওখানে গিয়েই শুরু হয়
সমস্যা। তিন বছর থাকার পর একদিন নন্দিনী পাঁচ বছরের ছেলে আদিলকে নিয়ে চলে আসে ঢাকায়।
টরন্টোয় আর ফিরে যায়নি। ঢাকায় এসে একটা ভালো চাকরিতে জয়েন করে। তাও তিন বছর হলো।
সেই থেকে নন্দিনী একদম একা। বছরে একবার কানাডা ঘুরে আসে আদিলকে নিয়ে। এর বাইরে তেমন
কোথাও যায় না। নিজেকে একটা খোলসে বন্দি করেছে নন্দিনী। অথচ তার মতো সুন্দরী মেয়েদের
এরকম খোলসবন্দি হওয়া মানায় না। নন্দিনী ইউএনএফপিএতে আইটি স্পেশালিস্ট হিসেবে কাজ
করছে। বেতন ভালো পায়। অফিস থেকে ফুলটাইম গাড়ি-বাড়িসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সবই পায়।
আদিলের বয়স সাত। সে আমেরিকান স্কুলে কেজি ওয়ানে পড়ে।
-কেমন আছ নন্দিনী?
-তুমি ফোন করার আর সময় পেলে না। এখন কটা বাজে জান?
-জানব না কেন? জানি।
-রাত-দুপুরে মানুষ ফোন করে?
সরি নন্দিনী। আমি জানি, বাকি রাত তুমি ঘুমাতে পারবে না। তোমার ঘুমের খুবই সমস্যা।
কী জন্যে ফোন করেছ বল। নিশ্চয়ই প্রেম করার জন্য নয়?
ও প্রান্তে হাসির শব্দ শোনা গেল। ‘ জানি তোমার প্রেমের যোগ্য আমিতো নাই..।’
-তোমার ভেতর ওটা আছে নাকি!
সবার ওটা থাকে না নন্দিনী। আমি জানি আমাকে বিয়ে করা তোমার ভুল সিদ্ধান্তের একটি। আমি
আসলে তোমার যোগ্য হয়ে উঠতে পারিনি।
বিয়েটা তোমার জন্য জরুরি ছিল না। তুমি তোমার ছাত্র আর বই নিয়ে থাকলেই ভালো করতে।
আদিল কেমন আছে?
ভালো। আর কিছু বলবে?
হ্যাঁ।
বলে ফেল।
কাল কয়েক দিনের জন্য ক্যানবেরা যাচ্ছি।
তো! এটা নতুন কোনো খবর নয়।
তা নয়। আসলে সবাই সংসারী হতে পারে না নন্দিনী। সংসার সবার জন্য নয়।
আজ এত ভনিতা করছ কেন?
রাগ করছ?
না।
আমি তোমাকে ভালোবাসি নন্দিনী।
তাই নাকি! আর তোমার ছাত্রী কারমেন? তাকে ভালোবাস না?
তাকেও বাসি।
ননসেন্স! ফোন রাখি।
জাস্ট অ্যা সেকেন্ড।
কী?
তুমি ইচ্ছে করলে ডিভোর্স নিতে পার।
তাই নেব।
নন্দিনী ফোন রেখে দিল। এরপর ঘরের লাইট জ্বালল। টেবিলঘড়িতে রাত পৌনে চারটা। সাইড
টেবিলে ঢেকে রাখা গ−াস থেকে পানি খেল ঢকঢক করে। পাশের ঘরে আদিল ঘুমানো। গত বছর থেকেই
আদিলকে একা ঘুমানোর অভ্যাস করিয়েছে। অবশ্য একজন আয়া আছে। শীত শীত লাগছে।
এয়ারকুলার কমিয়ে দিল। ওয়াশরুমে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াল। চুলগুলো এলোমেলো, নাইটির
ওপরের সবগুলো বোতাম খোলা। ফর্সা স্তনের ওপরের অংশ দেখা যাচ্ছে। চোখটা কেন যেন জ্বালা
করছে। পানি ছিটাল চোখেমুখে।
নন্দিনীকে দেখলে আসল বয়স বোঝা যায় না। এখনো যেন পঁচিশেই আটকে আছে। সরু কোমর,
ভারী নিতম্ব, কোমর সমান চুল, সুন্দর দুটি চোখ, উনড়বত বক্ষ- সবকিছু মিলিয়ে নন্দিনী অসাধারণ সুন্দরী
একটি মেয়ে। প্রায় দশ বছরের বিবাহিত জীবন আজ ভাঙনের দ্বারপ্রান্তে। শাহরিয়ারের সঙ্গে নন্দিনীর
বয়সের ব্যবধানও কম নয়। পঁচিশে নন্দিনীর বিয়ে হয়। আর শাহরিয়ারের বয়স তখন চলি−শ।
টরন্টোর প্রথম চার বছর এক রকম কেটে যাচ্ছিল। শাহরিয়ারের বয়স, ব্যস্ততা সবই মেনে নিচ্ছিল
নন্দিনী। নন্দিনী প্রথম কিছুদিন কাজও করছিল। আদিল হওয়ার পর নন্দিনী ব্যস্ত হয়ে উঠল ছেলেকে
নিয়ে। শাহরিয়ার আরও দূরে সরে যেতে লাগল। তার ব্যস্ততা বই, ইউনিভার্সিটি আর ছাত্র। আমেরিকা
যাওয়ার পর শাহরিয়ার আরও বদলে গেল। কারমেনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ল শাহরিয়ার। এটা নিয়ে তার
কোনো অনুতাপও হলো না। যেন এটা খুবই স্বাভাবিক। নন্দিনী চেষ্টা করেও না ফেরাতে পেরে নিজেই
চলে এল ঢাকায়।

ভালোবাসা কোথায় থাকে? কোথায় লুকানো থাকে ভালোবাসা? ভালোবাসা কি শুধুই ‘না’ পাওয়ার
নাম? ভালোবাসা কি শুধুই দুঃখের অভিলাষ? নন্দিনী দেখতে সুন্দরী ছিল বলে অনেকেই ওর প্রেমপ্রার্থী
ছিল। নন্দিনীর ছেলেবন্ধুর সংখ্যাও কম ছিল না। লেখক, সাংবাদিক, অভিনেতা, গায়ক সব ধরনের বন্ধুই
ছিল। কিন্তু নন্দিনী যেরকমটি ভালোবাসা চায় সেরকমভাবে কেউ এগিয়ে আসেনি। এদের কাউকেই তার
যোগ্য বলে মনে হয়নি। নন্দিনীর সুন্দর মুখের আড়ালে একটা অদ্ভুত মন আছে। কেউই সেই মনটাকে
ছুঁতে পারেনি। দুদিন পরই নন্দিনীর মনে হয়েছে- আরে, এরকম তো আমি চাই না! এরকম উদ্দম উচ্ছ¡ল
জীবনে হঠাৎ দমকা হাওয়ার মতো শাহরিয়ার এসে নন্দিনীকে কোথায় উড়িয়ে নিয়ে গেল। আজীবন
লালিত ভালোবাসার কবর রচিত হয়ে গেল। শাহরিয়ার বেশির ভাগই থাকত বিদেশে। ব্যস্ততার জন্য
বিয়ে করাই হয়ে উঠছিল না। নন্দিনীর বাবাই এ বিয়ের হোতা। বাবার কথা ফেলতে পারেনি। এলাম,
দেখলাম, জয় করলাম-এর মতো নন্দিনীকে জয় করে নিয়ে গেল শাহরিয়ার। প্রাথমিক অবস্থায় নন্দিনীরও
খারাপ লাগল না। শাহরিয়ার বিদ্বান, বিলাসী জীবন, সম্মান, অর্থ, বিদেশ ঘুরে বেড়ানো- একটা মেয়ের
জীবনে এরকম স্বপড়ব থাকতেই পারে।
-বল তো ভালোবাসা কোথায় থাকে?
আমি কি জানি নন্দিনী!
তুমি একটা বুদ্ধু।
ঠিক বলেছ। অনুভব হাসতে থাকে।
হাসবে না বলছি। কথায় কথায় তোমার হাসি আমার অসহ্য লাগে।
ওকে। ওকে। এই মুখে তালা। হাসব না।
বল ভালোবাসা কোথায় থাকে?
বলছি দাঁড়াও। ভালোবাসা থাকে ঠোঁটে।
অসভ্যতা করবে না।
তাহলে বুকে।
থাপ্পড় খাবে আমার।
তাহলে তোমার হাতে।
অনুভব! আমি রেগে যাচ্ছি।
আমি কীভাবে জানব ভালোবাসা কোথায় থাকে! খুবই জটিল জিনিস।
কেন জান না?
তুমি বলে দাও।
প্রায়ই ফোনে এরকম হালকা কথাবার্তা হয় অনুভবের সঙ্গে। অনুভব অদ্ভুত সরল ভালো একটি
ছেলে। জীবনের জটিলতা যেন ওেেক স্পর্শই করতে পারেনি। নন্দিনীর ভালো লাগে, খুব ভালো লাগে
ওকে। কিন্তু ওকে কাছে টেনে নিতে ভয় হয়। সেটা হচ্ছে হারানোর কষ্ট যে অনেক বেশি। অনুভবই কি
নন্দিনীর সেই ভালোবাসার নাম?
প্রথম পরিচয় বছরখানেক আগে, তখন বর্ষাকাল। মাঠ, ঘাট, বিল সব পানিতে টইটম্বুর। নন্দিনী
আশুলিয়ার দিকে এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল। একটা বিলের পাড়ে বসে নন্দিনী একটা
শাপলা ফুল তুলে আনার চেষ্টা করছিল। সূর্যটা ঠিক ওর পেছনে। অদ্ভুত এক কম্পোজিশন। হঠাৎ ক্লিক
শব্দে নন্দিনী কান খাড়া করে ওপরের দিকে তাকাল। দূরে একটি ছেলে তখনো ক্যামেরায় চোখ লাগিয়ে
বিভিনড়ব এঙ্গেলে ছবি তোলার চেষ্টা করছে। নন্দিনী ঘুরে দাঁড়ানোতে যেন ওর ছবি তোলায় ব্যাঘাত
ঘটেছে- এমনভাবে হাত তুলে নড়াচড়া করতে নিষেধ করছে। নন্দিনী রেগে বোঁ হয়ে ছেলেটির কাছে
এল।
-ছবি তুললেন কেন?
-বিউটিফুল!
-মানে?
-আপনি।
-জানেন, পারমিশন ছাড়া কারও ছবি তোলা অন্যায়? আপনাকে পুলিশে দিতে পারি?
-পারেন, কিন্তু দেবেন না।
-তার মানে?
-এত সুন্দর যে দেখতে, সে কখনো কাউকে পুলিশে দিতে পারে না। তবে ক্ষমা চাচ্ছি। আসলে দূর
থেকে এত অপরূপ মনে হয়েছিল শাপলা তোলার দৃশ্যটি, লোভ সামলাতে পারলাম না।
এসবই করে বেড়ানো হয় নাকি?
কোন সব?
মেয়ে দেখলেই ছবি তোলা?
সবার নয়। আমি একজন সৌখিন ফটোগ্রাফার। চাকরির বাইরে আমার একমাত্র কাজ ঘুরে ঘুরে ছবি
তোলা। আমাদের দেশটা যে কত সুন্দর, আমি সে সবই তুলি। আমার ছবিতে দু-একবার পুরস্কার
পেয়েছি ইতিমধ্যে।
আই সি। তা কী করা হয়?
ছবি তুলি আর একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করি। নিন। এই বলে ছেলেটি একটি কার্ড
নন্দিনীর হাতে দিয়ে কেটে পড়ল।
অনুভবের সঙ্গে প্রথম পরিচয়টা এভাবেই হয়েছিল।
৩.
এরপর তিন মাস অতিবাহিত হয়েছে। নন্দিনী তার অফিস আর ছেলেকে নিয়ে নিজের যে পৃথিবী
রচনা করেছে, তার মধ্যেই বিভোর। শাহরিয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ নেই বললেই চলে। নন্দিনীর ধারণা,
শাহরিয়ারের আপনভোলা ভাব স্রেফ একটা শয়তানি। কারমেনের সঙ্গে কীভাবে সে জড়িয়ে পড়ল! বিয়ের
আগেও শাহরিয়ারের জীবনে একাদিক মেয়ে এসেছে। ছেলেদের বিশ্বাস করা কঠিন। নন্দিনী নিজের
বাবা-মায়ের কাছে না থেকে একা থাকাটাকেই শ্রেয় মনে করেছে। বিয়ের পর বাবা-মায়ের কাছ থেকে
মেয়েদের একটু দূরে থাকাই ভালো। পুরানো বন্ধুরা প্রায়ই ফোন করে। অনেকে পুরানো প্রেমের প্রসঙ্গও
টেনে আনতে চায়। একজন নাট্যশিল্পী তো নিজের স্ত্রীকে ডিভোর্স করে নন্দিনীকে বিয়ে করতে প্রস্তুত।
খুবই জনপ্রিয় সে।
নন্দিনী গুলশান দুই নম্বরে ল্যান্ডভিউ মার্কেটে একটি সিডির দোকানে সিডি কিনতে গেল। নন্দিনী
থাকে ডিওএইচএস বারিধারায়। অফিসের দেয়া বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে। সিডি নিয়ে যখন বের হলো,
পেছন পেছন দৌড়ে এল ছেলেটি।
-এই যে শুনুন!
-আমাকে বলছেন? ঘুরে তাকাল নন্দিনী।
কেমন আছেন?
ও আপনি!
আশ্চর্য মানুষ তো আপনি!
কেন কী করেছি?
আমি যে কার্ড দিয়েছি, একটা ফোনও তো করলেন না। বাই দ্য ওয়ে, ভুলে গিয়েছিলেন জানি, নো
প্রবলেম। আমি অনুভব। এটা ডাকনাম। থাকি এই কাছাকাছিই।
-বিউটিফুল!
-মানে?
-আপনি।
-জানেন, পারমিশন ছাড়া কারও ছবি তোলা অন্যায়? আপনাকে পুলিশে দিতে পারি?
-পারেন, কিন্তু দেবেন না।
-তার মানে?
-এত সুন্দর যে দেখতে, সে কখনো কাউকে পুলিশে দিতে পারে না। তবে ক্ষমা চাচ্ছি। আসলে দূর
থেকে এত অপরূপ মনে হয়েছিল শাপলা তোলার দৃশ্যটি, লোভ সামলাতে পারলাম না।
এসবই করে বেড়ানো হয় নাকি?
কোন সব?
মেয়ে দেখলেই ছবি তোলা?
সবার নয়। আমি একজন সৌখিন ফটোগ্রাফার। চাকরির বাইরে আমার একমাত্র কাজ ঘুরে ঘুরে ছবি
তোলা। আমাদের দেশটা যে কত সুন্দর, আমি সে সবই তুলি। আমার ছবিতে দু-একবার পুরস্কার
পেয়েছি ইতিমধ্যে।
আই সি। তা কী করা হয়?
ছবি তুলি আর একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করি। নিন। এই বলে ছেলেটি একটি কার্ড
নন্দিনীর হাতে দিয়ে কেটে পড়ল।
অনুভবের সঙ্গে প্রথম পরিচয়টা এভাবেই হয়েছিল।
৩.
এরপর তিন মাস অতিবাহিত হয়েছে। নন্দিনী তার অফিস আর ছেলেকে নিয়ে নিজের যে পৃথিবী
রচনা করেছে, তার মধ্যেই বিভোর। শাহরিয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ নেই বললেই চলে। নন্দিনীর ধারণা,
শাহরিয়ারের আপনভোলা ভাব স্রেফ একটা শয়তানি। কারমেনের সঙ্গে কীভাবে সে জড়িয়ে পড়ল! বিয়ের
আগেও শাহরিয়ারের জীবনে একাদিক মেয়ে এসেছে। ছেলেদের বিশ্বাস করা কঠিন। নন্দিনী নিজের
বাবা-মায়ের কাছে না থেকে একা থাকাটাকেই শ্রেয় মনে করেছে। বিয়ের পর বাবা-মায়ের কাছ থেকে
মেয়েদের একটু দূরে থাকাই ভালো। পুরানো বন্ধুরা প্রায়ই ফোন করে। অনেকে পুরানো প্রেমের প্রসঙ্গও
টেনে আনতে চায়। একজন নাট্যশিল্পী তো নিজের স্ত্রীকে ডিভোর্স করে নন্দিনীকে বিয়ে করতে প্রস্তুত।
খুবই জনপ্রিয় সে।
নন্দিনী গুলশান দুই নম্বরে ল্যান্ডভিউ মার্কেটে একটি সিডির দোকানে সিডি কিনতে গেল। নন্দিনী
থাকে ডিওএইচএস বারিধারায়। অফিসের দেয়া বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে। সিডি নিয়ে যখন বের হলো,
পেছন পেছন দৌড়ে এল ছেলেটি।
-এই যে শুনুন!
-আমাকে বলছেন? ঘুরে তাকাল নন্দিনী।
কেমন আছেন?
ও আপনি!
আশ্চর্য মানুষ তো আপনি!
কেন কী করেছি?
আমি যে কার্ড দিয়েছি, একটা ফোনও তো করলেন না। বাই দ্য ওয়ে, ভুলে গিয়েছিলেন জানি, নো
প্রবলেম। আমি অনুভব। এটা ডাকনাম। থাকি এই কাছাকাছিই।
এত কিছু তো জানতে চাইনি, বলে নন্দিনী হাসল। হাসিটা আনন্দের। কারণ ছেলেটার সরলতা ওর
ভালোই লাগছে। কোনো জটিলতা নেই। চোখ দুটোই বলে দেয় এই ছেলে অন্যরকম।
তাতে কী, আমার পরিচয়টা দেব না। চলুন ওপরে একটা রেস্টুরেন্ট আছে, বসা যাক।
জানি। কিন্তু এখন বসার সময় নেই।
আরে চলুন তো, একটা জিনিস দেখাব আপনাকে। বলেই অনুভব নন্দিনীর হাত ধরে টান দিল।
নন্দিনী জানে এটা অভদ্রতা। কিন্তু ছেলেটি এটা করেছে সরলভাবে। নন্দিনী হাত ছাড়িয়ে নিল।
বলল, চলুন।
কোনার দিকে একটা টেবিল বেছে নিল। নন্দিনী ওর ভুবনভোলা হাসি ছড়িয়ে দিয়ে বলল, লোকেরা
কী মনে করবে? এভাবে হাত ধরে…
ও তাইতো! খেয়াল ছিল না। সরি! আপনি মাইন্ড করেছেন?
নন্দিনী কপট তাকিয়ে বলল, হুঁ।
-প−ীজ!
-ওকে। মাইন্ড করিনি।
-থ্যাঙ্কস!
নন্দিনী এই প্রথম অনুভবের দিকে তাকাল। লম্বা, হ্যান্ডসাম দেখতে অনুভব। সারল্যে ভরা চেহারা।
– কী দেখাবেন বলছিলেন।
-এ জন্যেই তো তিন মাস ধরে খুঁজছি আপনাকে। আপনি ফোন করবেন না জানলে আমিই সেদিন
আপনার ফোন নম্বর নিতাম। অনুভব ওর ব্যাগ থেকে একটা খাম বের করে দিল নন্দিনীকে। নন্দিনী
ছবিগুলো দেখল। অনেকক্ষণ ধরে।
-কেমন?
নন্দিনী আবার বড় বড় চোখে অনুভবের দিকে তাকিয়ে বলল, সুন্দর!
-আপনার জন্য। চাইলে নেগেটিভ দিয়ে দিতে পারি।
দরকার নেই।
আমার কাছে থাকবে?
হ্যাঁ।
এরপর প্রায়ই অনুভবের সঙ্গে দেখা হতে লাগল। ফোনে কথা হয় যখন-তখন। সব বিষয় নিয়েই ওরা
কথা বলতে পারে। দুজনে তুমি করে সম্বোধন করে। অনুভবের প্রতি তীব্র এক আকর্ষণ অনুভব করে
নন্দিনী। এই আকর্ষণ কি প্রেমের না সেড়বহের, বুঝতে পারে না নন্দিনী। বুঝতে পারে অনুভবও তীব্রভাবে
ওর প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। অনুভবের চোখ দেখলেই বোঝা যায়। নন্দিনী জানে, অনুভব ওর চেয়ে পাঁচ
বছরের ছোট। নন্দিনী কীভাবে যে দূরে সরে থাকবে বুঝতে পারে না।
অনুভব গাড়ি ড্রাইভ করছে, নন্দিনী পাশে বসা। অফিসের পর মাঝে মাঝেই দুজন বেড়াতে বের হয়।
ওরা যাচ্ছে মেঘনা সেতুর দিকে।
অনুভব, আমি মনে হয় শাহরিয়ারকে ডিভোর্স করছি। সে-ই চাচ্ছে। তুমি কি বল?
-তুমি সেদিন জিজ্ঞেস করছিলে না, ভালোবাসা কোথায় থাকে? আমি উত্তর পেয়ে গেছি।
থাক বলতে হবে না।
তুমি ডিভোর্স করে দাও। আমি তোমাকে বিয়ে করব নন্দিনী।
যাহ্, তা হয় না।
কেন?
আমি আর বিয়েই করতে চাই না।
আমি তোমাকে বিয়ে করব নন্দিনী। এটাই ফাইনাল।
আচ্ছা সেটা দেখা যাবে। এখন গাড়ি চালাও।
তুমি একটু অন্যরকম নন্দিনী। নন্দিনীর হাত ছুঁয়ে খুব গাঢ় গলায় বলে অনুভব।
নন্দিনী হাত ছাড়িয়ে নেয় না। আরও অনুভবের কাছ ঘেঁষে বলে, তুমি খুব ভালো অনুভব। খু-উ-ব।
ওরা নদীর পাড় ধরে হাঁটছে। সুন্দর বিকেল। এক অপরূপ মায়ময় পরিবেশ।
-তোমাকে শাড়ি পরলে খুব সুন্দর লাগে নন্দিনী। শাড়ি আমার খুব পছন্দ।
-এখন থেকে শাড়িই পরব সব সময়।
না না, তা কেন?
তোমার পছন্দ যে তাই।
তুমি আমার একটা কথা এড়িয়ে যাচ্ছ।
কী কথা?
তোমাকে বিয়ে করতে চাই। তোমাকে সারাক্ষণ ভাবি আমি। আমার ভালো লাগে। কোথা থেকে যে
এত ভালোবাসা আসে! এর নামই কি ভালোবাসা নন্দিনী?
অনুভব তোমাকেও আমার ভালো লাগে। তুমি খুব ভালো। অনেস্ট। কিন্তু এটা হয় না অনুভব।
কেন নয়! অসুবিধা কোথায়?
দেখ, আমার ছেলে আছে। তাছাড়া…
কী?
তুমি আমার ছোট।
অনুভব হো হো করে হেসে উঠল।
হাসছ কেন?
এমনি। আমি তোমাকে বিয়ে করছি। ওকে?
আই নিড সাম মোর টাইম।
ওকে। তবে একটা প্রশড়ব…
কী?
তুমি কি অন্য কাউকে বিয়ে করতে চাও?
না।
তবে?
আমার সময় দরকার।
৪.
অনুভব ঠিক করে রেখেছে, বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে নন্দিনীকে আর বিব্রত করবে না। এটা নন্দিনীর
নিজস্ব সিদ্ধান্ত। ওর এত তাড়াহুড়া নেই। মাকে ম্যানেজ করা কোনো ব্যাপার হবে না। বিয়ের মতো
একটা ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া অতো সহজ নয়। অনুভব নিজের দিক থেকে পরিষ্কার। নন্দিনীকে ও
ভালোবাসে এবং বিয়ে করতে চায়। আদিলকেও ও পছন্দ করে। আদিলও অনুভবকে খুবই পছন্দ করে।
অনুভব জানে, নন্দিনী অনেক দ্বিধাদ্ব›েদ্ব আছে। সে আর একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে অনেক ভাবতে চায়।
অনুভবও নন্দিনীকে ভাবার সুযোগ দিয়েছে। যত খুশি, যতদিন ইচ্ছে ভাবুক। নন্দিনী শাহরিয়ারকে
ডিভোর্স করার ব্যাপারটা নিয়েই বেশি ভাবছে। নন্দিনী না বললেও ও বুঝতে পারে। যদিও অনুভব জানে,
এটা কোনো বড় ব্যাপার না। নন্দিনীর ওকে ডিভোর্স করার পেছনে যথেষ্ট যুক্তি আছে। তারপরও
মেয়েদের মন তো! তারা স্বামীর অনেক অপরাধই ক্ষমার চোখে দেখে। নন্দিনী হয়তো ভাবছে শাহরিয়ার
একদিন ভুল বুঝবে এবং ওর কাছেই ফিরে আসবে। এরকম কি আর হয় না? ওসব সাময়িক আবেগ
বেশি দিন থাকে না। আমেরিকান সোসাইটির মেয়েদের ‘প্রেম’ কী জিনিস তা আর কে না জানে!
সকালের প্রেম বিকেলে ভেঙে যায়।
গত বেশ কয়েক দিন অনুভবের সঙ্গে নন্দিনী দেখা করেনি। অনুভবও দেখা করার জন্য কোনো
জোরাজোরি করেনি। যদিও অনুভবের সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে নন্দিনী। নন্দিনীও অনুভবকে খুবই পছন্দ
করে। খু-উ-ব পছন্দ অনুভবকে। কিন্তু ভালোবাসে কি না সে সম্পর্কে নন্দিনী নিজেও পরিষ্কার না।
ভালোবাসা বড়ই জটিল জিনিস। একেক সময় মনে হয় সত্যি বোধহয় অনুভবকে ও ভালোবাসে। আবার
একেক সময় মনে হয়, না, এটা ভালোবাসার মতোই কিছু কিন্তু ঠিক ভালোবাসা নয়। প্রতিদিন অনুভব
একবারই নন্দিনীকে ফোন করে। সেটা রাতে। নিয়ম করে ফোন করে। এমনকি অনুভব গত সপ্তাহের
পুরোটা যখন দিলি−তে ছিল, অফিসের একটা ট্রেনিং প্রোগ্রামে, তখনও প্রতিদিন ফোন করেছে।
এখন বিকেল। ভ্যাপসা গরম চারদিকে। কোনো বাতাস নেই। বৃষ্টিও হয় না। ঢাকা শহরটা যেন দিন
দিন অগিড়বকুণ্ডে পরিণত হচ্ছে। চারদিকের স্কাই¯ঙঊ্যাপার এত হচ্ছে যে, বাতাস চলাচলের জায়গা থাকছে
না। নন্দিনী দশ মিনিটে ঘেমে উঠেছে। কারণ ঘরের মধ্যে এসি চলছে না। ঘণ্টাখানেক ধরে বিদ্যুৎ নেই।
ও বসে আছে ধানমন্ডির একটি অ্যাডভার্টাইজিং এজেন্সিতে। এজেন্সির কর্ণধার দেশের একজন প্রথিতযশা
নায়ক। খুবই জনপ্রিয় এই গায়কের সঙ্গে নন্দিনীর দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব। খুবই ভালো বন্ধু ওরা। যদিও এই
গায়ক একজন বিবাহিত মানুষ, তারপরও এদের বন্ধুত্বে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। আমি উঠব।
আর একটু বোস। কারেন্ট চলে আসবে।
আজ মুড নেই রে।
সেই তখন থেকে গোমরা মুখে বসে আছিস। কফি খাবি আর এক কাপ?
না। এক কাপ খেয়ে মুখটা তেতো হয়ে আছে।
সিগারেট খাবি?
না। খবরদার এই বদ্ধ ঘরে সিগাটে জ্বালাবি না।
ওকে বাবা, জ্বালাব না। ফুচকা আনাই। ফুচকা খা। তুই তো আবার মাঝে মাঝেই তোর কৈশোরের
প্রেমিকদের সঙ্গে বেইলি রোডে ফুচকা খেতে যাস।
তাতে তোর কোনো অসুবিধা আছে?
হ্যাঁ, আছে। আমি জেলাস।
তুই জেলাস হবি কেন? তুই কি আমার প্রেমিক?
তবে কি ওই নায়ক তোর প্রেমিক?
চুপ থাক তো!
ওকে বাবা। তোর ওই বালকটির খবর কী, যে তোর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে?
ভালো। ভালো ছেলে, অনেস্ট, সাহসী, যে আমাকে বিয়ে করতে চায়।
করে ফেল।
করব। সময় হলেই করব।
শিউর!
এই সময় কারেন্ট চলে এল।
উঠি রে।
কারেন্ট এল আর তুই চলে যাবি? চল সন্ধ্যার পর একটা গানের রেকর্ডিং আছে গুলশানে।
না, যাব না।
নন্দিনী বের হয়ে গাড়িতে উঠল। কোথায় যাবে ঠিক করতে পারছে না। গত রাতে শাহরিয়ার ফোন
করেছিল। ফোনে কথা বলার পর কান-মাথা গরম হয়ে আছে। লোকটা একটা ইরিটেটিং, অসহ্য।
কেমন আছ?
তোমাকে বলেছি না, রাতদুপুরে ফোন করবে না?
সরি নন্দিনী। খেয়াল ছিল না। আসলে অস্ট্রেলিয়া থেকে বাংলাদেশের সময়ের পার্থক্যটা আমি ঠিক জানি
না।
তুমি ঠিকই জান। তুমি হচ্ছ জ্ঞানপাপী।
এভাবে কথা বলছ কেন?
কীভাবে তুমি আশা করছ?
আদিল কেমন আছে?
এসে দেখে যাও।
হ্যাঁ, শিগগিরই আসছি। কাল ফিরে যাচ্ছি ক্যালিফোর্নিয়া। তুমি কী ডিসিশন নিলে?
কিসের ডিসিশন?
আমি কারমেনকে বিয়ে করছি নন্দিনী।
খুবই ভালো খবর।
শুনলাম তুমিও নাকি এক যুবকের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছ?
তুমি পারলে আমি পারব না কেন?
আমি উকিল নোটিশ পাঠাচ্ছি।
পাঠাও।
তুমি তাহলে মেনে নিচ্ছ?
কেন নয়? তোমার কি ধারণা, আমি তোমার শোকে কেঁদে কেঁদে বালিশ ভিজিয়ে ফেলব? বলব, প−ীজ
এটা করো না।
না, তুমি এটা করবে না।
তাহলে?
আমার ধারণা, তুমি এই বিচ্ছেদ মেনে নিতে পারবে না।
তোমার ধারণা ভুল শাহরিয়ার।
আর ইউ শিওর?
শোন, রাতদুপুরে তোমার ন্যাকামি শুনতে আমার ভালো লাগছে না। তোমার যা ইচ্ছে করো।
নন্দিনী খটাস করে ফোন রেখে দিল। এরপর সারা রাত নন্দিনী ঘুমাল না। উঠে বাথরুমে গেল,
চোখেমুখে পানি দিল। দুই গ−াস পানি খেল। খুব মনে পড়তে থাকল অনুভবের কথা, ভাবল ওকে ফোন
করে কথা বলে। কিন্তু এর কিছুই করল না। সারা দিন অফিস করল। অফিস থেকে বরে হয়ে গেল
ধানমন্ডিতে আকবরের অফিসে। মনে হয়েছিল ওর কাছে গেলে ভালো লাগবে। কিন্তু আকবরকেও আজ
ভালো লাগল না। নন্দিনী ইচ্ছে করে অনুভবকে অ্যাভয়েড করছে। এর কারণ কী? অনুভবের প্রতি
অভিমান? অনুভব হঠাৎ করে কেমন নির্লিপ্ত হয়ে গেছে। বিয়ের প্রসঙ্গ আর ওঠায়ই না। তাহলে কি…
গাড়ি মগবাজার এসে জ্যামে আটকে আছে। সেলফোন থেকে ফোন করল নাট্য শিল্পীকে। দেশের
সবচেয়ে জনপ্রিয় শিল্পী। যার অভিনয় দেখার জন্য পাগল ছেলেমেয়েরা। সেই শিল্পী পাগল নন্দিনীর
জন্য।
কোথায় তুমি?
আমি মগবাজার, গাড়িতে। তুমি কি ফ্রি আছ?
তুমি চাইলে আমি ফ্রি।
না বলো কোথায় তুমি?
স্টুডিওতে। একটা রেকর্ডিং আছে।
তাহলে থাক।
না, বলো।
এমনি। মনটা ভালো নেই।
বলো কোথায় আসব?
না, থাক। তোমার শুটিংএর অসুবিধা হবে।
নন্দিনী পি−জ! ।
আজ থাক।
নন্দিনী ফোন কেটে দিল। আজ কোনো ছন্দ খুঁজে পাচ্ছে না। আসিফ কেন বলল ওর শুটিংএর কথা? না
বললে হয়তো দেখা হতে পারত। দেখা করেই বা কী হবে? নন্দিনী কি চাইবে আসিফ ওর সংসার ভেঙে
ওকে বিয়ে করুক? নদিন্দী তা কখনোই চাইবে না। নন্দিনী ওরকম মেয়েই না।
৫.
ওর গাড়ি যখন অস্ট্রেলিয়া অ্যাম্বাসি স করছিল তখন সেল ফোন বেজে উঠল। নম্বরটা দেখে মনটা
খুশিতে নেচে উঠল। আবার পরক্ষণেই অভিমানে বুকটা ভরে গেল। নম্বরটার দিকে তাকিয়ে থাকে
থাকতে চোখটা হঠাৎ জ্বালা করে উঠল। এর মানে কি? নন্দিনী কি মনে মনে ওর কথাই ভাবছিল না?
একেই কি বলে টেলিপ্যাথি? এরকম হওয়া কি খুব অসম্ভব? এরকম কি হয় না? খুব হয়।
ফোন থেমে গেল। নম্বরটা খুব চেনা। খুউবই চেনা এই নম্বর। ও কি কলব্যাক করবে? থাক। একটু পর
আবার বেজে উঠল ফোন। গাড়ি ততÿণে পাকিস্তান অ্যাম্বাসি ছাড়িয়ে গেছে। ও যাচ্ছে বাসার দিকে।
ডিওএইচএস বারিধারা।
হ্যালো।
গলা থেকে স্বর প্রায় বেরই হলো না। কেমন কানড়বা কানড়বা। আসলে নন্দিনী ওর অবরুদ্ধ অভিমানকে
কোনোরকম ধরে রেখেছে।
নন্দিনী তুমি কোথায়?
বাসায় যাচ্ছি।
নিনফাসে আসতে পারবে? আমি তোমার জন্য্য ভেজিটেবল স্যুপ অর্ডার দিয়েছি। তোমার প্রিয়। কথা
বলছো না কেন? তোমার কি হয়েছে? নন্দিনী গাড়ি ঘোরালো। গুলশান-২ নম্বর চত্ত¡রে আসতে যে
ক’মিনিট লাগলো সে ক’মিনিট নন্দিনী মনের সুখে কাঁদল। কেঁদে কেঁদে একটু হালকা হলো। ও কাঁদল
খুবই নীরবে যাতে ড্রাইভার বুঝতে না পারে। রুমাল দিয়ে চোখ মুছে ও। নিনফাসে অনুভবের মুখোমুখি
বসল।
অনুভব একটু চমকে উঠল ওকে দেখে। চোখ ফেলা দেখে বুঝতে পারল কেঁদেছে।
নন্দিনীর প্রতি মায়ায় বুকটা ভেঙে যেতে লাগলো, আর্দ্র হয়ে উঠল মন। কিন্তু অনুভব এসব বুঝতে দিতে
চায় না। সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গে কথা শুরু করলো।
নন্দিনী তুমি আগ্রা গিয়েছো? এবার দেখে এলাম তাজমহল। পৃথিবীতে এত সুন্দর যে আছে আমার জানা
ছিল না। তুমি গিয়েছো আগ্রায়?
নন্দিনী চুপ করে থাকলো। অনুভব ওর বাটিতে স্যুপ ঢেলে দিল। নন্দিনী চামচ নাড়াচাড়া করছে শুধু।
অসম্ভব সুন্দর নন্দিনীকে আজ কেমন ফ্যাকাসে লাগছে। চোখের নিচে কালি, ক্লান্ত, কেমন আলুথালু।
এররকম কখনো ওকে দেখেনি অনুভব। আশ্চর্য ব্যাপার, প্রায় ৩৩ দিন পর আজ দেখা হলো।
এবার অনেক ছবি তুলেছি নন্দিনী। তুমি দেখবে? সব নিয়ে এসেছি। ইস, তুমি যদি থাকতে আমার
পাশে! এত সুন্দর একা এক এনজয় করা যায় না। এরকম জায়গায় আপনজন কেউ থাকলে মজা আরো
কয়েকগুণ বেশি হতো। তুমি কি রেগে আছো আমার ওপর?
না, কেন রাগবো?
রাগবে না! বলো কি!! তাহলে কার ওপর রাগবে?
তুমি আমার কে যে রাগ করবো?
আমি তোমার কেউ না? এটা কি বলছো নন্দিনী।
ঠিকই বলছি। তুমি কেন এতদিন আমার সঙ্গে দেখা করনি?
তুমি তো বলনি একবারও।
বলতে হবে তোমাকে? সবকিছু বলে দিতে হয়?
নন্দিনী আমি বুঝতে পারিনি। আমি তোমাকে সময় দিতে চেয়েছি, তুমি সময় চেয়েছিলে। আমি একটা
বুদ্ধু। গাধা। মাফ চাইছি। পি−জ নন্দিনী।
নন্দিনীর রাগ চলে যাচ্ছে। এ ছেলের ওপর রাগ করা যায় না। অনুভব সত্যি সত্যি হয়ত ওকে ভাবার
সুযোগ দিয়েছে।
তোমার সঙ্গে দেখা না হওয়াতে আমি খুব কষ্ট পাচ্ছি। খু-উ-ব। আমার পৃথিবীটা বিষাদময় হয়ে ছিল
এতদিন। এখন আমার ভালো লাগছে। খুব ভাল লাগছে।
আমারও। বলে হাসলো নন্দিনী। ওর সেই বিখ্যাত হাসি।
তোমার কি হয়েছে? আমি জানি তুমি কেঁদেছো। শাহরিয়ার কিছু বলেছে?
উকিল নোটিশ পাঠাচ্ছে।
ভালো তো।
কি ভালো?
একটা ফয়সালা হওয়া দরকার। তুমি তোমার মন ঠিক কর। আমি বিয়ে করার জন্য তৈরি। যে কোনো
দিন, যে কোনো সময়। মাকে তোমার কথা সব বলেছি। একদিন নিয়ে যাবো। চলো, আজই যাই।
আজ থাক অনুভব।
কেন থাকবে?
না, আজ না। অন্য একদিন যাবো।
আমি কোনোদিন তোমাকে ছেড়ে যাবো না। কোনোদিন না অনুভব একটু আবেগাপ−ু হলো, চোখটা হঠাৎ
ভিজে উঠল। বলল, তোমার মত একটা মেয়ে পেলে জীবনে আর কিছু চাই না। সেদিনের সেই
কম্পোজিশনের কথা আমার ভেতরে গেঁথে আছে। সেই তোমার অপূর্ব ভঙ্গিমা। যেদিন তুমি শাপলা ফুল
তুলছিলে।
তুমি একটা পাগল!
বিয়ে করবে কি না সেটাই বলছো না। অনেক তো সময় নিলে।
দেখি, তোমার দিলি−র ছবি দেখাও। নন্দিনী প্রসঙ্গটা বদলাতে চাচ্ছে।
অনুভবের এই গুরুত্বপূর্ণ কথাটার উত্তর এখনো যে তৈরি করেনি নন্দিনী।
তোমার কি কোনো তাড়া আছে?
কেন?
আজ অনেক ঘুরবো।
আদিল বাসায় একা।
ওকে নিয়ে আসি চলো।
থাক। ওকে মার বাসায় পাঠিয়ে দেই বরং।
নন্দিনী ড্রাইভার ছেড়ে দিল। বলে দিল আদিলকে মার বাসায় দিয়ে আসতে। নন্দিনী ফেরার পথে তুলে
নিয়ে যাবে।
এখন রাত বাজে প্রায় ন’টা। এত রাতে কোথায় যাওয়া যায় চট করে বুঝতে পারলো না অনুভব। এই
দেশটা এখন কোনো নিরাপদ দেশ নয়, মানুষের তেমন কোনো প্রাইভেসি নেই। লং ড্রাইভের চিন্তা বাদ
দিল অনুভব। ঢাকা শহরের মধ্যেই ঘুরে বেড়াবে। ঘুরে ঘুরে ঢাকা শহর দেখবে। এটার মধ্যে এক
ধরনের মজা আছে। সবচেয়ে বড় কথা, নন্দিনীর সঙ্গে যতখানি সময় থাকা যায়। কেন যে এত ভাল
লাগে ওকে!
নন্দিনী, আমি এখন জানি ভালোবাসা কোথায় থাকে।
কোথায়?
ভালোবাসা আসলে একটি দুঃখবোধের নাম। এটা মনের এমন এক জায়গায় থাকে যা কাউকে ব্যাখ্যা
করে বলা যায় না।
খুব ফিলসফার হয়ে যাচ্ছো মনে হয়।
ভালোবাসার মানুষের প্রতি কেন এত তীব্র আকর্ষণ জন্মায় আমার ধারণা ছিল না। কেন যে এমন হয়!
আমাকে তুমি কেন ভালোবাসলে অনু?
আমি জানি না। আমি কিছুই জানি না।
তুমি তো একবারও জিজ্ঞেস করোনি আমি তোমাকে ভালোবাসি কিনা!
অনুভব চমকে নন্দিনীর দিকে তাকালো। তাই তো! তাহলে ভালোবাসা কি একতরফা হয়ে গেল?
অনুভবের ধারণা নন্দিনীও তাকে ভালোবাসে। নন্দিনী আবার বলল, অনুভব ভালোবাসা অনেক দামি
জিনিস। তোমার ভালোবাসায় কোনো খাদ নেই আমি জানি। তোমার সামনে পড়ে আেিছ একটি
সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ। আমি চাই না তুমি এমন কোনো ভুল কর যাতে ভবিষ্যতে তোমার একথা মনে হতে
পারে যে, তুমি ভুল করেছো।
আমি জেনেশুনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
তারপরও তুমি আরো ভাবো। আমি তোমাকে ঠকাতে পারবো না। তোমাকে পছন্দ করি বলেই পারবো
না।
আজ এসব কথা বলছো কেন নন্দিনী?
জানি তোমার খারাপ লাগছে। সময়ে সব আবার ঠিক হয়ে যায়। তোমাকে আমার কি দেয়ার আছে বল?
আমি তোমার যোগ্য নই। অনুভবের সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল। নন্দিনী এসব কি বলছে? ওর কি মাথা
খারাপ হয়ে গেছে?
তোমাকে আমি চিরদিন মনে রাখবো। চিরদিন অনু।
নন্দিনী আর বলতে পারলো না। ওর কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে এল। নন্দিনী আবার কেঁদে ফেলল। কেন তা
জানে না। ফুঁপিয়ে উঠল। কেঁপে কেঁপে উঠল শরীর।
কেন তোমার সঙ্গে আমার দেখা হলো। আমি এরকম চাইনি। তোমার কষ্ট আমি সহ্য করতে পারবো না।
তুমি অনেক ভালো অনুভব। তুমি আমাকে ভুলে যাও। আমি তোমার বন্ধু হয়ে থাকতে চাই।
আমি তোমাকে বিয়ে করবোই নন্দিনী। তুমি আমাকে ফেরাতে পারো না।
৬.
পঁচিশ বছর পর
ঘরের বারান্দায় আরাম চেয়ারে যে ভদ্রমহিলা বসে আছেন তিনি নন্দিনী। মাথাভরা সেই চুল এখনো
আছে, তবে তার সবই প্রায় সাদা। চোখে দামি রিমলেস চশমা, অফ হোয়াইট কালারে শাড়ি পরিহিত।
দু’হাতে দুটি সোনার চুড়ি। এই সাজেও তাকে অপূর্ব লাগছে। বোঝাই যায় এক সময়ে র্দুদান্ত সুন্দরী
ছিলেন। নন্দিনীর কোলের কাছে তার সাত বছরের নাতনি। গতকালই এসেছে বাবার সঙ্গে কানাডা
থেকে। আদিলের একমাত্র কন্যা। আজ থেকে পঁচিশ বছর আগেই শাহরিয়ারের সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে যায়
নন্দিনীর। তারপর থেকে নন্দিনী একা। সেও বহুবছর কানাডা কাটিয়ে এখন দেশেই বসবাস করছে।
আদিল তাকে চমৎকার একটি বাড়ি কিনে দিয়েছে ঢাকায়। সেখানেই নন্দিনী থাকে। আদিল তার স্ত্রী ও
কন্যাকে নিয়ে কানাডায় সেটেল্ড। গতকাল ওরা এসেছে ওকে দেখতে।
এই ছবিগুলো কার তোলা দাদীমা?
চমৎকার বাংলা শিখেছে পল−বিনি।
আমার এক বন্ধুর।
কি নাম তোমার বন্ধুর?
অনুভব।
সেই ছবিগুলো, যেগুলো অনুভব তুলেছিল প্রথম দিন শাপলা তোলার সময়।
তোমার বন্ধু এখন তোখায়?
কোথায় কোথায় যে থাকে। আমি কি আর জানি সব!
জানো না কেন?
আমাকে যে কিছু বলে যায় না।
কেন বলে যায় না?
আমি তার কি জানি!
খুব দুষ্টুতো তোমার বন্ধু।
হ্যাঁ, খুব দুষ্টু। একদম কথা শোনে না।
আজও নন্দিনী সেই দিনটির কথা ভুলতে পারে না। শাহরিয়ারের সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ায় যত না
ভেঙে পড়েছিল তার চেয়ে বেশি ভেঙে পড়েছিল অন্য একটি ঘটনায়। শাহরিয়ারের সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে
যাওয়ার পর অনুভবই নন্দিনীর ব্যথার সাথী হয়েছিল। সারাক্ষণ ছায়ার মতো ওর সঙ্গে সঙ্গে থেকেছে।
নন্দিনীর সমস্ত কষ্ট ভুলিয়ে দিতে চেষ্টা করেছে। অনুভবের এই মানবিক দিকটির সঙ্গে পরিচয় ছিল না।
ধীরে ধীরে ভালোবাসা জন্মাতে থাকে ওর প্রতি। যখন মন প্রায় ঠিক করে ফেলেছে তখনই ঘটনাটা ঘটে।
এরকম ঘটনা সাধারণত সিনেমায় ঘটে। কিন্তু বাস্তবেও যে এরকম হয় নন্দিনীর তা জানা ছিল না।
একদিন অনুভবের মা জাহানারা বেগম নন্দিনীকে ডেকে পাঠালেন। তিনি যথেষ্ট দৃঢ়ভবে বললেন,
আমি চাই না অনুভবের সঙ্গে তোমার বিয়ে হোক।
কেন?
ঘটনার আকস্মিকতায় নন্দিনী বিমুঢ় হয়ে গেল।
তুমি ওকে ভুলে যাও।
ও যদি ভুলতে পা,ের আমার কোনো অসুবিধা নেই।
ওর ব্যাপারটা আমি দেখবো। পি−জ, তুমি ওকে ভুলে যাও।
এতে করে ওর ক্ষতি করাই হবে শুধু।
সেটা আমার ব্যাপার।
আমি ওর সঙ্গে কথা বলব।
না। পি−জ না। তুমি ওকে কিছু বলবে না। আমি যে বলেছি তা বলবে না।
আমি এতটা নিষ্ঠুর হতে পারবো না। আমার অপরাধ কি বলেন।
আমি আর কিছু বলতে চাই না।
ঠিক আছে।
বলে নন্দিনী চলে এল। নন্দিনী তার কথা রেখেছে। সে অনুভবের কাছ থেকে সরে এসেছে এবং বলেছে
সে যেন কখনো নন্দিনীর কাছে আর না আসে। অনুভব তার অপরাধ কি জানতে চেয়েছিল, নন্দিনী
বলেছে অপরাধ সব আমার। আমি আর দ্বিতীয় বিয়ে করতে চাই না। আমি আর কোনোদিন বিয়ে করবো
না। তুমি বিয়ে করে সুখী হও অনুভব। তোমার মাকে সুখী কর।
তোমাকে না পেলে আমি আর বিয়েই করবো না।
দেখতে দেখতে পঁচিশটি বছর পার হয়েছে। নন্দিনী এবং অনুভব দুজনেই কথা েেখছে। কেউ আর বিয়ে
করেনি। জাহানারা বেগম ছেলের বিয়ে দিতে সক্ষম না হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
অনুভবের সঙ্গে নন্দিনীর আর কি কখনও দেখা হয়েছিল?
এই প্রশেড়বর উত্তর অজানাই রয়ে গেল।
Comments Off on অনুভব