জাকাত ইসলামী জীবন বিধানের অন্যতম মৌল ভিত্তি ও অবশ্য পালনীয় ফরজ ইবাদত। অর্থসম্পদের দিক দিয়ে সামর্থøবান প্রত্যেক মুসলমানের ওপর জাকাত আদায় করা ফরজ। আর্থিক সামর্থøবান বলতে জাকাতযোগ্য সম্পদের মালিক হওয়াকে বোঝায়।
জাকাত আরবি শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে পবিত্রতা, ক্রমবৃদ্ধি, আধিক্য ইত্যাদি। পারিভাষিক অর্থে জাকাত বলতে ধনীদের মালে আল্লাহর নির্ধারিত অংশকে বোঝায়। বস্তুত জাকাত হচ্ছে সম্পদশালীদের সম্পদে আল্লাহর নির্ধারিত সেই ফরজ অংশ যা সম্পদ ও আত্মার পবিত্রতা অর্জন, সম্পদের ক্রমবৃদ্ধি সাধন এবং সর্বোপরি আল্লাহর রহমত লাভের আশায় নির্ধারিত খাতে দান করা। জাকাত সুন্দর সমাজ গড়ার অন্যতম হাতিয়ার। কেননা জাকাতের মাধ্যমে ফকির-মিসকিন অসহায় মানুষ কিছুটা হলেও তার অভাব পূরণ করার প্রয়াস পান। এর মাধ্যমে সমাজের সাম্য ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া জাকাত ও সদকা হলো রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য লাভের মাধ্যম। আল-কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘(হে রাসূল) আপনি তাদের সম্পদ থেকে জাকাত গ্রহণ করুন, এর দ্বারা আপনি তাদেরকে পবিত্র করবেন এবং পরিশোধিত করবেন (সূরা তাওবা-১০৩)। জাকাত প্রদানের গুরুত্ব সম্পর্কে রাসূল সাঃ-এর একটি হাদিস হজরত আবু হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত আছে এক বেদুঈন ব্যক্তি নবী করিম সাঃ-এর খিদমতে উপস্থিত হয়ে বললেন, আমাকে এমন একটি আমল বলে দিন যা করে আমি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারব। রাসূল সাঃ বললেন, তুমি আল্লাহর ইবাদত করবে তার সাথে কাউকে শরিক করবে না, নামাজ আদায় করবে, রোজা রাখবে এবং ফরজ জাকাত আদায় করবে। এরপর সে বলল, ‘যার হাতে আমার প্রাণ সেই আল্লাহর কসম আমি এর থেকে কম বা বেশি কোনোটাই করব না।’ যখন সে ফিরে যাচ্ছিল তখন রাসূল সাঃ বললেন, যদি তোমরা জান্নাতি কোনো ব্যক্তিকে দেখতে চাও তাহলে তাকে দেখো (বুখারি)। মূলত জাকাত একটি সুখময় সমাজ গঠনের জন্য ইসলামের এক চিরন্তন বিধান। কুরআন ও হাদিসে স্পষ্ট ভাষায় জাকাতের বিধিবিধান বর্ণনা করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনুল কারিমের ৩২ জায়গায় জাকাতের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে ২৮ জায়গায় নামাজ ও জাকাতের কথা একসাথে বলা হয়েছে। আলকুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘তোমরা উত্তম কাজের যা কিছু পূর্বে প্রেরণ করবে আল্লাহর নিকট তা পাবে, তোমরা যা কিছু করো অবশ্যই আল্লাহ তা দেখেন (সূরা বাকারা-১১০)।
বস্তুত ইসলামে নামাজ ও জাকাতের মধ্যে পার্থক্য করার কোনো অবকাশ নেই। দু’টি ইবাদতই অবশ্য পালনীয় ফরজ। যার মধ্যে ছাড় দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে জায়িদ রাঃ বলেন, ‘নামাজ ও জাকাত উভয়ই ফরজ এ দু’টির মধ্যে কোনো পার্থক্য করা হয়নি।’
জাকাত আদায়ের পুরস্কার ও জাকাত না দেয়ার জন্য কঠোর বাণী উচ্চারণ করেছেন রাসূল সাঃ। তিনি বলেন, ‘কেউ যদি আল্লাহর পুরস্কারের আশায় জাকাত দেয় তাহলে সে আল্লাহ তায়ালার কাছে উত্তম ও সম্মানজনক পুরস্কার পাবে। কিন্তু যে জাকাত আদায়ে অস্বীকার করবে তার কাছ থেকে শক্তি প্রয়োগ করে জাকাত আদায় করা হবে। এবং আল্লাহর ভয়াবহ শাস্তি তো আছেই’ (বুখারি, মুসলিম ও বায়হাকি)। আলকুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘দুর্ভোগ মুসরিকদের তারা জাকাত দেয় না এবং আখেরাতেও অবিশ্বাসী (সূরা হামিম-৬-৭)।
কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তায়ালা ইসলামের ভ্রাতৃত্বের সীমার মধ্যে শামিল হওয়ার জন্য জাকাত আদায় করাকে শর্ত করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে, ‘যদি তারা তাওবা করে নামাজ পড়ে, জাকাত আদায় করে, তবে তারা তোমাদের (মুমিনদের) দ্বীনি ভাই’ (সূরা তাওবা-১১)।
যে ব্যক্তি বা যে সমাজের মানুষ জাকাত দেয় তাদের ওপর মহান আল্লাহ তায়ালার রহমত নাজিল হয়, আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমার রহমত সব কিছু পরিব্যাপ্ত করে আছে। সুতরাং আমি তা তাদের জন্য নির্ধারিত করব যারা তাকওয়া অবলম্বন করে, জাকাত দেয় এবং আমার নিদর্শনের প্রতি ঈমান রাখে (সূরা আরাফ-১৫৬)।
মূলত ইসলাম জাকাতের মাধ্যমে সমাজের এ সামগ্রিক কল্যাণ সাধন করেছে। কেননা মানুষের মধ্যে শান্তি স্থাপনের অন্যতম প্রকৃষ্ট উপায় হলো ধনসম্পদ বণ্টনের সুষম ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় সাম্য-সমতা প্রতিষ্ঠিত হয়।
জাকাতের একটি বিশেষত্ব এই যে, এটি গোপনে দান করার ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়েছে। জাকাত অন্তরকে উদার ও সহানুভূতিশীল করে তুলতে সাহায্য করে। মানুষ একান্তভাবে প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, সমাজ ও দেশের কল্যাণকর্মে নিয়োজিত হওয়ার শিক্ষা লাভ করে। এতে বিশ্বমানবতার সাথে একাত্মবোধের সৃষ্টি হয়। পার্থিব সম্পদরাজি ও পারলৌকিক পুরস্কার এ দুয়ের সমন্বয় সাধনের প্রচেষ্টা থাকার মধ্যেই জীবনের সফলতা নিহিত।
Leave a Reply