মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত

মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত

একজন মা সন্তানের ধরাধামে আবির্ভাব ও অস্তিত্ব বজায় রাখার ক্ষেত্রে অসাধারণ ত্যাগ স্বীকার ও অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট বরদাশত করেন। ৯ মাস গর্ভে ধারণ করে তার রক্ষণাবেক্ষণ করেন। আবার ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরও দুই বছর পর্যন্ত স্তন্যদানের কঠিন ঝামেলা পোহাতে হয় তাকে।

আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘আর আমি মানুষকে তার মা-বাবার সাথে সদ্ব্যবহারের জোর নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে। তার দুধ ছাড়ানো দুই বছরে হয়। নির্দেশ দিয়েছি, আমার প্রতি ও তোমার মা-বাবার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। অবশেষে আমারই কাছে ফিরে আসতে হবে। (সূরা লোকমানঃ ১৪)।

সন্তানের কাছে মা-বাবা উভয়েই অতি আদরের ধন। তার পরও মা সন্তানকে যেভাবে বুকে ধারণ করেন তা বাবার দ্বারা আদৌ সম্ভব নয়। আর প্রতিটি সন্তানই তার মায়ের কাছে যেভাবে তার আবদার, চাওয়া-পাওয়ার বায়না ধরে তা বাবার কাছে তুলে ধরতে পারে না। আর মা সন্তানের সব আবদার পূরণে সদাসর্বদা ব্যস্ত থাকেন। ভালো খাবার, ভালো জামাকাপড়, সুন্দর সুগঠিত স্বাস্থ্য, ভালোভাবে লেখাপড়া করা অর্থাৎ সব ভালো সব মায়ের সন্তানের দরকার। প্রত্যেট মায়ের চাওয়া-পাওয়া একই ধরনের। আমার সন্তান ভালো থাকুক, সুস্থ থাকুক।

যে মায়ের সন্তানের প্রতি এত দরদ এত মায়া, সে মায়ের প্রতি সন্তানের ভালোবাসা কতটুকু হতে পারে, মানবতার মুক্তিদূত হজরত মুহাম্মদ সাঃ সুন্দরভাবে তার বর্ণনা দিয়েছেন।

হজরত আবু হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত­ তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসূল সাঃ-এর কাছে এসে বলল­ হে আল্লাহর রাসূল, আমার কাছ থেকে সদ্ব্যবহার ও সৎসঙ্গ পাওয়ার সবচেয়ে বেশি অধিকারী কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে বলল, এরপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে আবার বলল, এরপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে বলল, এরপর কে? তিনি বললেন, তোমার বাবা। (বুখারি)।

হজরত আসমা রাঃ রাসূল সাঃকে জিজ্ঞেস করেন, আমার মা মুশরিক। তিনি আমার সাথে দেখা করতে আসেন। তাকে কী আদর আপ্যায়ন করব? তিনি উত্তরে বললেন, তোমার মাকে আদর আপ্যায়ন অবশ্যই করবে। (বুখারি)

মা মুশরিক ও অমুসলিম হলেও তার প্রতি সদাচরণের কথা থেকে পরিষ্কারভাবে বুঝা যায়, তার প্রতি কখনো অন্যায় বা অবিচার করা যাবে না।

আসলে মা-বাবা উভয়েই সন্তানের কাছে অতি প্রিয়। কেননা বাবা ছাড়া পৃথিবীতে সন্তানের আগমন অসম্ভব। আর বাবাই সন্তানের খাদ্য সংগ্রহ করে থাকেন। মা-বাবা উভয়েই সন্তান লালন-পালনে কষ্ট করে থাকেন। এ জন্য ইসলামের বার্তাবাহক হজরত মুহাম্মদ সাঃ তাদের উভয়ের প্রতি সদাচরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন।

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাঃ থেকে বর্ণিত­ তিনি বলেন, আমি নবী সাঃকে জিজ্ঞেস করলাম, কোন কাজটি আল্লাহর কাছে সবচেয়ে উত্তম? তিনি বললেন, ঠিক সময়ে নামাজ আদায় করা। আমি আবার বললাম, এরপর কোনটি? তিনি বললেন, মা-বাবার সাথে সদ্ব্যবহার করা। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, এরপর কোনটি? তিনি বললেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। (বুখারি)।

ইবনে মাজাহ বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি রাসূল সাঃকে জিজ্ঞেস করল সন্তানের ওপর মা-বাবার হক কী? তিনি বললেন, তারা উভয়েই তোমার জান্নাত অথবা জাহান্নাম। উদ্দেশ্য এই যে, তাদের আনুগত্য ও সেবাযত্ন জান্নাতে নিয়ে যায় এবং তাদের সাথে বেয়াদবি ও তাদের অসন্তুষ্টি জাহান্নামে পৌঁছে দেয়।

মা-বাবার সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টির ওপরই নির্ভর করে পরকালীন জীবনের কল্যাণ ও অকল্যাণ। ইবনে আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণিত­ রাসূল সাঃ বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর ওয়াস্তে মা বাবার আনুগত্য করে, তার জন্য জান্নাতের দু’টি দরজা খোলা থাকবে এবং যে ব্যক্তি তাদের অবাধ্য হবে, তার জন্য জাহান্নামে দু’টি দরজা খোলা থাকবে। যদি মা বাবার মধ্য থেকে একজনই থাকে, তবে জান্নাত অথবা জাহান্নামের একটি দরজা খোলা থাকবে। এ কথা শুনে জনৈক ব্যক্তি প্রশ্ন করল­ জাহান্নামের এই শাস্তিবাণী কি তখনো প্রযোজ্য যখন মা-বাবা এই ব্যক্তির প্রতি জুলুম করে। তবু মা-বাবার অবাধ্যতার কারণে সন্তান জাহান্নামে যাবে। এর সারমর্ম এই, মা-বাবার কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণের অধিকার সন্তানের নেই। তারা জুলুম করলে সন্তান সেবাযত্ন ও আনুগত্যের হাত গুটিয়ে নিতে পারে না। (বায়হাকি শোয়াবুল ঈমান)।

যে মা গর্ভধারণের কষ্ট সহ্য করলেন, কষ্ট করে লালন-পালন করে বড় করে তুললেন, যে বাবা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অর্থ উপার্জন করে সন্তানের খাবার ও অন্যান্য প্রয়োজন মিটালেন, আজকাল দেখা যায়, তারা কখনো কখনো সন্তানের অসহ্যের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই আজকের সভ্য সমাজে বৃদ্ধ মা-বাবার জন্য বৃদ্ধাশ্রম তৈরি করা হয়েছে। আর অসভ্য ও বর্বর সন্তানেরা তাদের মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসে স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সুখে বসবাস করে বাড়িতে।

কী নিষ্ঠুর অমানবিকতা! মা-বাবার কাছে এর চেয়ে দুঃখ ও কষ্টের আর কী হতে পারে? যে সন্তানের জন্য মা তার রাতের ঘুম হারাম করেছেন, আর বাবা তার শরীরের রক্ত পানি করেছেন, তাদের জীবনের একি মূল্যায়ন!

আজকের সভ্য সমাজের সন্তানদের রাসূলের দু’টি হাদিসের দিকে দৃষ্টি দেয়া উচিত। ইবনে আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণিত­ রাসূল সাঃ বলেন, যে সেবাযত্নকারী পুত্র মা-বাবার দিকে দয়া ও ভালোবাসাসহকারে দৃষ্টিপাত করে, তার প্রত্যেক দৃষ্টির বিনিময়ে সে একটি মকবুল হজের সওয়াব পায়। লোকেরা আরজ করল­ সে যদি দিনে ১০০ বার এভাবে দৃষ্টিপাত করে? তিনি বললেন, হঁ্যা, ১০০ বার দৃষ্টিপাত করলেও প্রত্যেক দৃষ্টির বিনিময়ে এই সওয়াব পেতে থাকবে। (বায়হাকি)

মা-বাবা যাদের জীবিত আছেন তাদের উচিত মা-বাবার প্রতি সুদৃষ্টি দেয়া এবং তাদেরকে সব সময় খুশি রাখা। তাদের প্রতি খারাপ আচরণ না করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, আর তোমার রব আদেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তাকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করবে না এবং মা-বাবার সাথে সদাচরণ করবে। তাদের একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার কাছে বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে ‘উফ’ বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিয়ো না। আর তাদের সাথে সম্মানজনকভাবে কথা বলো। (বনি ইসরাইলঃ ২৩)

মা-বাবা সন্তানের জন্য দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জাহানের জন্য রহমতস্বরূপ। যে সন্তান মা-বাবার সন্তুষ্টি অর্জন করতে ব্যর্থ হলো তার চেয়ে দুর্ভাগা এ ধরায় আর কে হতে পারে? হজরত আবু হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত­ নবী সাঃ বলেন, ওই ব্যক্তির নাক ধূলিমলিন হোক, ওই ব্যক্তির নাক ধূলিমলিন হোক, ওই ব্যক্তির নাক ধূলিমলিন হোক, যে তার মা-বাবা উভয়কে অথবা উভয়ের একজনকে বৃদ্ধ অবস্থায় পেয়েও (তাদের সেবা করে) বেহেশতে যেতে পারল না। (মুসলিম)

Leave a comment