বোরকা পরিধানে বাধ্যকরণ

বোরকা পরিধানে বাধ্যকর

গত ২২ আগস্ট হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ স্বপ্রণোদিত হয়ে এ মর্মে আদেশ জারি করেন যে, ‘বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান,কর্মস্থল বা কোনো সরকারি কার্যালয়ে বোরকা কিংবা ধর্মীয় পোশাক পরিধানে বাধ্য করা যাবে না।’ শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিপত্রের মাধ্যমে হাইকোর্টের এ রায় মেনে চলার জন্য সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানকে নির্দেশ জারি করে। শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য এক সভায় বলেন, ‘বোরকা পরিধানে যেমন বাধ্য করা যাবে না, তেমনি বোরকা পরিধান না করতেও বাধ্য করা যাবে না।’ একটি বিষয় স্পষ্ট হওয়া দরকার যে, হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতিদ্বয় কিন্তু বোরকা পরিধান নিষিদ্ধ করেননি বরং বোরকা পরিধানে ‘বাধ্য করা’কে নিষিদ্ধ করেছেন। এ আদেশের ফলে দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। মুসলমান মেয়েদের জন্য পর্দা মেনে চলা তথা বোরকা পরিধান করা পবিত্র কোরআন ও হাদিসের নির্দেশনা অনুযায়ী বাধ্যতামূলক। বাধ্যতামূলক যে কোনো ধর্মীয় কর্মকাণ্ড পরিপালনে বাধ্য করা সঙ্গত ও যৌক্তিক। মুসলিম সমাজে অভিভাবকরা তাদের কন্যাসন্তান ও স্বামীরা তাদের স্ত্রীদের শরিয়তের নির্দেশ মেনে বোরকা পরিধান তথা পর্দা প্রথা মেনে চলতে এমনভাবে অনুপ্রাণিত করেন, যাকে বাধ্য করা হিসেবেও বর্ণনা দেয়া যায়। এটা মুসলিম সমাজে প্রচলিত একটি প্রতিষ্ঠিত রেওয়াজ ও প্রাচীন প্রথা। ইংল্যান্ডে রেওয়াজ ও প্রথা আইনের মতো পালনীয় ও অলঙ্ঘনীয়।

হাইকোর্টের এ রায় শরিয়তের নির্দেশনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক কওমি ও আলিয়া পদ্ধতির মহিলা মাদ্রাসা, স্কুল ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের শালীনতা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে বোরকার আদলে বাধ্যতামূলক নিজস্ব ড্রেস কোড রয়েছে। আদালতের নির্দেশ অমান্য করলে জেল খাটতে হয়, অপরদিকে শরিয়তের নির্দেশ না মানলেজাহান্নামে যেতে হবে। জনগণ কোন নির্দেশ অনুসরণ করবে? এমন বিব্রতকর পরিস্থিতি কোনো গণতান্ত্রিক মুসলিমপ্রধান দেশে কাম্য হতে পারে না। আদালতকে সব সময় বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখা বা ঊর্ধ্বে থাকা প্রয়োজন। পার্থিব ন্যায়বিচারের শেষ আশ্রয়স্থল আদালত (ঈড়সঢ়বঃবহঃ ঈড়ঁত্ঃ)। আদালতের প্রতি মানুষের অশ্রদ্ধা বা অবজ্ঞা প্রদর্শন আইনের শাসনের জন্য হুমকিস্বরূপ। পৃথিবীর কোনো আদালত ইসলামের বিধিবিধান বাতিল, স্থগিত, রহিত ও অবজ্ঞা করতে পারেন না, তবে সংবিধানের সংশ্লিষ্ট ধারা অনুবলে শরিয়তের আইন প্রয়োগ করতে পারেন বা প্রতিষ্ঠিত মাজহাবের (ঝপযড়ড়ষং ড়ভ ঞযড়ঁমযঃ) নীতিমালা অনুযায়ী ব্যাখ্যা দিতে পারেন। আল্লাহ তায়ালাকে অসন্তুষ্ট করে কোনো মানুষকে সন্তুষ্ট করা ইসলামে সরাসরি নিষিদ্ধ। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)কে নির্দেশ দিয়ে বলেন,
হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীদের, কন্যাদের ও মুমিনদের নারীদের বলুন, তারা যেন তাদের জিলবাবের (এমন পোশাক যা পুরো শরীরকে আচ্ছাদিত করে) কিছু অংশ নিজেদের ওপর ঝুলিয়ে দেয়, তাদের চেনার ব্যাপারে এটাই সবচেয়ে কাছাকাছি পন্থা হবে। ফলে তাদের উত্ত্যক্ত করা হবে না। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু (সূরা আল-আহজাব : ৫৯)।

বাংলাদেশে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটেছে বার বার। কখনও সামরিক সরকার, এরশাদ সরকার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, বিএনপি বা কখনও আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছে কিন্তু দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্মাশ্রয়ী জীবনবোধ ও আচরণে বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি। বরং দৈনন্দিন জীবনে ধর্মকে সর্বাত্মকভাবে আঁকড়ে ধরার প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। চলতি বছর বাংলাদেশে পরিচালিত গ্যালপ জরিপে বাংলাদেশের ১০০% মানুষ বলেছেন, তাদের দৈনন্দিন জীবনে ধর্ম অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণে অকারণে ধর্ম, ঐতিহ্য ও ধর্মীয় অনুশাসনের বিরুদ্ধে বলা ও কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়ার নৈমিত্তিক ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। নানামুখী অপপ্রচারের কারণে ধর্মের অনুশাসন নির্মিত বিধিনিষেধ ও আচার-ব্যবহার সাময়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। অপরদিকে ভারতে রাজনৈতিক নেতা, মিডিয়া, বুদ্ধিজীবী ও আদালত বৈদিক ধর্মীয় আদর্শ, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে জনসমক্ষে তুলে ধরতে এক পায়ে খাড়া। হিন্দু রাজনীতিক-বুদ্ধিজীবী-সাংবাদিকদের হিন্দু তথা সনাতন ধর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে দেখা যায় না।
পাশ্চাত্য সমাজ ও আমাদের সমাজ ব্যবস্থা এক নয়। ইসলাম বাংলাদেশের সামাজিক আচরণের প্রধান সঞ্চালক শক্তি। মুসলমানরা একটি ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার-ঐতিহ্যের ধারক। তারা সবকিছু পরিত্যাগ করতে রাজি কিন্তু ইসলামকে ত্যাগ করতে প্রস্তুত নয়। সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিস্ট (ইড়ষংযবারশ) সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর রাষ্ট্রীয় বিধিনিষেধ জারি করে সে দেশের মুসলমানদের ৭০ বছরব্যাপী ইসলামী শিক্ষা গ্রহণ, চর্চা ও অনুশীলন বন্ধ করে দিয়েছিল। কমিউনিজমের পতনের পর পুরো দেশে ইসলাম তার হৃত শক্তি ও প্রাণপ্রবাহ ফিরে পায়। তুরস্কে কামাল আতাতুর্ক ইসলাম চর্চা ও অনুশীলনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও স্বল্প সময়ের ব্যবধানে তুরস্কে ইসলাম নিয়ামক শক্তিরূপে পুনরাবির্ভূত হয়। সম্প্রতি গণভোটের মাধ্যমে তুরস্ক ইসলামী মূল্যবোধ সংবলিত সাংবিধানিক সংস্কারের পথে এগুচ্ছে। ধর্মনিরপেক্ষ পশ্চিমা মূল্যবোধ থেকে সরে এসে ইসলামী মূল্যবোধকে রাষ্ট্রীয়নীতির অন্তর্ভুক্ত করার একটি ঐতিহাসিক অগ্রগতি অর্জন করতে যাচ্ছে।
বোরকা বা হিজাব নারীর শালীন পরিচ্ছদ। খোদ পাশ্চাত্য বিশ্বেও নারীর উগ্র পোশাক নিয়ে আপত্তি দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি ব্রিটেনে অফিসে কর্মরত মেয়েদের মিনি স্কার্ট পরে কাজে আসা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, বিশেষ করে যাদের সরাসরি কাস্টমারদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ করতে হয় তাদের শিশু ও পরিবারের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের স্বার্থে আরও পেশাদারিত্বের চিত্র ফুটিয়ে তুলতে শালীন পোশাক পরতে হবে। ডেইলি মেইলে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাউদাম্পটন সিটি কাউন্সিলের শিশু সেবা দফতরে কর্মরত প্রায় ৪০০ স্টাফকে অফিসিয়াল ড্রেস সম্পর্কিত একটি স্মারকলিপি দেয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, যেহেতু তারা বাচ্চাদের নিয়ে কাজ করেন সেহেতু কাজের ধরন ওক্ষেত্রের কথা বিবেচনা করে তাদের শালীন পোশাক পরিধান করা উচিত। কাউন্সিলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা স্মারকলিপিতে বলেন, যেসব মেয়ে মিনি স্কার্ট পরে অফিসে আসবেন তাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হবে। পুরুষদের ড্রেস কোড বলা হয়েছে—কলারবিশিষ্ট পোলো শার্ট ও সুতি পাজামা। মেয়েরাও পাজামা বা সাধারণ যে কোনো পোশাক এমনকি স্কার্টও পরতে পারবে তবে তা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য সাইজের হতে হবে।

বোরকা মুসলমান নারীদের ইজ্জত ও শালীনতার প্রতীক। পর্দা ও হিজাবের সঙ্গে মুসলমান নারীর স্বাধীনতা ও মর্যাদার প্রশ্ন জড়িত। পর্দা পালন ইবাদত, একটি প্রাচীন প্রথা ও রেওয়াজ; দেড় হাজার বছরের ঐতিহ্য। এর সঙ্গে ধর্মীয় বাধ্যতামূলক বিধি সম্পৃক্ত। অভিভাবকরা তাদের পোষ্যদের, সরকারি-বেসরকারি অফিসের নির্বাহী কর্মকর্তারা নিজস্ব বিধিবদ্ধ নিয়ম (জঁষবং ড়ভ ইঁংরহবংং) অনুসারে এবং প্রতিষ্ঠান প্রধানরা সিন্ডিকেট/ম্যানেজিং কমিটি/গভর্নিং বডির সিদ্ধান্ত অনুসারে তাদের অধীনস্থ বা শিক্ষার্থীদের বোরকা বা ধর্মীয় পোশাক পরিধানে বাধ্য করতে পারেন।মুসলমান মহিলা ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বীরা এ বাধ্যবাধকতার আওতায় আসবেন না, তবে তারা নারীসুলভ শালীন পোশাক পরিধান করবেন। আমাদের আশা করা উচিত, হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের মাননীয় বিচারপতিরা তাদের প্রদত্ত রায়কে পুনর্বিবেচনায় এনে ধর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় এমন একটি রায় প্রদান করবেন, যা এ দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়। এতে ধর্মীয় বিধিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে না এবং আদালতের মর্যাদাও অক্ষুণ্ন থাকবে।

Leave a comment